শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ০৩:২৬ পূর্বাহ্ন

ই -কমার্স-সমিতির নামে লুটপাট এখন শহর থেকে গ্রামে,এরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

রিপোটারের নাম
প্রকাশের সময় : রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দি বাংলা খবর ডেস্ক ::ই-কমার্স ও সমবায় সমিতির নামে গ্রাহকের কাছ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন গ্রাহকরা। অর্ধেক দামে পণ্য দেওয়ার নামে সহস্রাধিক ক্রেতার কাছ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ গ্রাহকের কাছে পণ্য পাঠানো হয়নি। ধর্মের নামে ১৭ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এহসান গ্রুপ। আর রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন সমবায় সমিতির নামে দ্বিগুণ মুনাফার কথা বলে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। অনেক সমবায় সমিতি গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে।

বিভিন্ন সময় এসব ই-কমার্স ও সমবায় সমিতির নামে প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা মামলা করেছেন। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি। এরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? স্থানীয় প্রভাবশালীদেরও ম্যানেজ করে ফেলে তারা। মাস্তানও পোষে। টাকা চাইতে গেলে গ্রাহককে মারপিটসহ নানাভাবে হয়রানিও করা হয়। করোনার সময় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে তারা। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে ছয় মাস আগে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়েছিল। সেখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল, ই-কমার্সের ব্যাপারে একটা নীতিমালা করুন। নইলে তারা বড় ধরনের অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে অর্থ পাচার করবে। কিন্তু কোনো আইন কিংবা নীতিমালা করা হয়নি।

এতে কোটি কোটি আত্মসাৎ করে পাচার করেছে একটি চক্র। তাদের অনেকটা সুযোগই করে দেওয়া হয়েছে। আইন না থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে গেলে ব্যবসায়ীরা তাদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করত। আর সমবায় সমিতির নামে হায় হায় কোম্পানি সারা দেশে যে ছড়িয়ে পড়েছে সেটিও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এইসব কোম্পানির প্রতারণা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অভিহিত করা হয়। এই সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি দেশব্যাপী গ্রাহকদের প্রতিবাদ ও নানা সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের তদন্তে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও পণ্য সরবরাহ করেনি। সেই টাকার হদিসও নেই। এমনকি মার্চেন্টদের থেকে পণ্য এনে সেই টাকাও তারা পরিশোধ করেনি। তাহলে কোথায় গেল এত টাকা, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সম্প্রতি এসপিসি ওয়ার্ল্ড ও ধামাকা শপিং নামের দুটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের তদন্ত করতে গিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। পরে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা করে সিআইডি।

জানা গেছে, প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে বর্তমানে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস, ২৪ টিকেট ডট কম, গ্রিনবাংলা, এক্সিলেন্ট বিগবাজার, ফাল্গুনিশপসহ প্রায় ২৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক, পুলিশ, র‍্যাব, সিআইডিসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন। এরমধ্যে ই-অরেঞ্জ গ্রাহকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, ধামাকা শপিং ৮০০ কোটি টাকা, ইভ্যালি ১ হাজার কোটি টাকা, নিরাপদ ডটকম ৮ কোটি টাকা আত্মসাত্ করেছে। তবে একের পর এক প্রতারণার ঘটনা সামনে আসলেও হচ্ছে না প্রতিকার। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বাইরে দেশব্যাপী কাজ করছে এ রকম কয়েক হাজার ছোট প্রতিষ্ঠান। ফেসবুক, ইউটিউব ছাড়া নিজেদের অ্যাপস, ওয়েবসাইট খুলে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

চলতি বছরের শুরুতে বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা ও গ্রাহকদের বিক্ষোভ শুরু হলে নড়েচড়ে বসে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা। গত জুলাইয়ে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মামলা ও কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়। বেশ কয়েকটি ব্যাংক ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনলাইন লেনদেন স্থগিত করে। তবে লাখ লাখ গ্রাহকের টাকা কীভাবে ফেরত আসবে, সেই বিষয়টি এখনো অজানা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-কমার্সের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষই লাভবান হচ্ছে। সেখানে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও নজরদারির অভাবে বাংলাদেশে ই-কমার্সের মাধ্যমে প্রতারণা শুরু হয়েছে। পুরো আর্থিক ব্যবস্থায় শৃিঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে (ক্যাব) প্রতিদিনই শত শত অভিযোগ জমা পড়ছে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত ১৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৩ হাজার ৩১৭টা অভিযোগ জমা পড়ে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে। প্রতিষ্ঠার তিন বছর না যেতেই ইভ্যালির বিরুদ্ধে জমা পড়ে ৪ হাজার ৯৩২টি অভিযোগ। সম্প্রতি আলোচনায় আসার আগেই ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এরপর কয়েক সপ্তাহে তাদের বিরুদ্ধে সহস্রাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। এ ছাড়া ফাল্গুনি শপ, প্রিয় শপ, দারাজ, সহজ ডটকম, আজকের ডিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে ভোক্তা অধিকারে। বেশির ভাগ অভিযোগ নির্ধারিত সময়ের দুই-তিন মাস পরও পণ্য বুঝে না পাওয়া নিয়ে। এর বাইরে ‘চেক ডিজঅনার’ হওয়া, ‘রিফান্ডের’ টাকা ফেরত না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

এদিকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করার পর তা ফেরত দিচ্ছে না ২৬৬টি সমবায় সমিতি। এসব সমিতির বেশির ভাগ তাদের কার্যালয় বন্ধ করে পালিয়েছে। সমবায় অধিদপ্তর সারা দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত উধাও হয়ে যাওয়া সমিতিগুলোর ওপর ঐ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নথিপত্রে থাকা হিসাবের বাইরেও প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। সদস্য ও সদস্যদের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে এসব সমিতির মূল কৌশল ছিল উচ্চ মুনাফার লোভ। লোভে পড়ে অনেকেই এসব সমিতিতে টাকা রাখেন। যেমন—২০০৯ সালে গ্রামীণ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি প্রতি ১ লাখ টাকায় মাসে ২ হাজার টাকা বা ২৪ শতাংশ মুনাফার লোভ দেখিয়ে শান্তিনগরের বাসিন্দা আর হোসেনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়। এক বছর তারা ঠিকমতো মুনাফার টাকা দিলেও এরপর নিয়মিতভাবে তা দেয়নি। এখন জমা টাকাও খোয়া গেছে।

রাজধানীর মিরপুরে নবাবেরবাগ রংধনু বহুমুখী সমবায় সমিতি ২০১৩ সালে কাজ শুরু করে। সহস্রাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সমবায় সমিতিটি। চাকরিজীবী, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এই সমিতির গ্রাহক। প্রতারণার শিকার গ্রাহকেরা শাহআলী থানায় তিনটি প্রতারণার মামলা করেছে, কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। র‍্যাব তদন্ত করছে। সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধিত এটি। প্রতারণা যেন সমবায় সমিতিগুলোর টাকা কামানোর বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নিরীহ মানুষকে প্রতারণা করার কি তারা লাইসেন্স পেয়েছে? আইন অনুযায়ী ব্যাংক ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। সমবায় সমিতি কেবল সদস্যদের অর্থ জমা রাখতে পারে। কিন্তু এসব সমবায় সমিতি বছরের পর বছর ধরে প্রকাশ্যে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করে উধাও হয়ে গেছে।

র‍্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও সমবায় সমিতির নামে অনেক সময় মামলা করেন গ্রাহকেরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু প্রতারকেরা টাকা দিয়ে গ্রাহককে ম্যানেজ করে ফেলেন এবং মামলা তুলে নেন। এ কারণে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। তবে এবার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশব্যাপী অভিযান অব্যাহত থাকবে। প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা হবে। প্রতারণা করে কেউ আর রেহাই পাবেন না।

সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতারণার শিকার গ্রাহকেরা যখন মামলা করেন, তখন নিখুঁতভাবে তদন্ত করা হয়। তবে কোনো না কোনোভাবে আসামিরা সুযোগ পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে তারা যাতে সুযোগ পেয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও সমবায় সমিতির নামে যারা প্রতারণা করছে, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সিআইডির অভিযান অব্যাহত থাকবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ