শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ০৫:০৬ পূর্বাহ্ন

আল্লাররহমতে দেশে বিপদ-আপদ কাটছেই না

রিপোটারের নাম
প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ৩০ জুলাই, ২০২১

দি বাংলা খবর ডেস্ক ::করোনা মহামারী থেকে পরিত্রাণের প্রত্যাশা নিয়ে ২০২১ সাল শুরু করেছিল দেশবাসী। কিন্তু নতুন বছর এসে প্রায় সাত মাস কেটে গেলেও মহামারী থেকে পরিত্রাণ মেলেনি, দেখা দেয়নি স্বস্তির ভোর; বরং করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা গত বছরের প্রথম ঢেউকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের ‘অতি প্রকোপে’ কল-কারখানা, অফিস আদালতসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ থাকায় বা স্বাভাবিকভাবে না চলায় অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়েছে। সাধারণ মানুষের আয় উদ্বেগজনক হারে কমে গেছে। করোনার দীর্ঘ অভিঘাতে এর মধ্যেই দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। অতিমারীর সঙ্গে চলতি বর্ষায় যোগ হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এমনতিইে হাসপাতালে শয্যা সংকট; করোনা আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না, এর সঙ্গে বিশেষ করে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে বাড়তি চাপ পড়ায় দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কাও করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনা বিপদ নিয়ে রাজধানীবাসী যখন উৎকণ্ঠিত, তখন নতুন আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। অন্যদিকে গ্রামের মানুষও ভালো নেই। বানের পানি সেখানে আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। গত কদিনের জোয়ারে ও প্রবল বর্ষণে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি। সব মিলিয়ে একের পর এক সংকটের আবর্তে দেশের মানুষ; বিপদ-আপদ কাটছে না কিছুতেই। মাঝে বিরতি দিয়ে গত দেড় বছর বিধিনিষেধের আদলে লকডাউন চলছে বাংলাদেশে। ঈদুল আজহার পর গত ২৩ জুলাই

থেকে চলছে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ। যার কারণে ঘরবন্দি মানুষ জমানো সঞ্চয়ে হাত দিয়েছেন। কারও কারও সঞ্চয় আগের বছরই ফুরিয়ে গিয়েছিল; চলছেন ধার-কর্য করে। এ দিকে করোনায় আক্রান্ত হলে মিলছে না সুচিকিৎসা। বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অধিকাংশ মানুষকে। ঢাকার বাইরে অক্সিজেন সংকটের কারণে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিন। শয্যা সংকটের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা মিলছে না। করোনা হানা দিয়েছে বাংলাদেশে, প্রথম এ তথ্য আসে গত বছরের ৮ মার্চ। এর পরই আসে ঢেউ। সেই ঢেউ গত বছরের শেষদিকে কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলেও চলতি বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দিয়েছে আরও ভয়াবহ, আরও প্রাণঘাতী হয়ে। দেশবাসীর জন্য করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে এখনো। যেভাবে টিকাদান কার্যক্রম চলছে তাতে গণটিকাদান কর্মসূচি শেষ হতে বেশ কয়েক মাস লেগে যাবে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটাও বিলম্বিত হবে।

করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বমন্দা না কাটায় প্রবাসী শ্রমিকেরা অনেকে কর্মহীন, দেশে ফিরেছেন হাজার হাজার কর্মী, সাধারণ মানুষের হাতে নগদ অর্থ নেই, চাকরির বাজার খুবই খারাপ, বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ৩০-৪০ শতাংশ, কারও কারও বেতনও কমেছে। সবচেয়ে বড় কথা- বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ একেবারেই কমে গেছে।

অর্থনীতির সংকট কাটাতে মহামারী নিয়ন্ত্রণে চলমান কঠোর লকডাউনের মধ্যে পোশাক শিল্পসহ সব ধরনের কারখানা খুলে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন শিল্পমালিকরা। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ, ঢাকা চেম্বার ও এফবিসিসিআইয়ের নেতারা গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে এক বৈঠকে এ অনুরোধ জানান। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর শঙ্কা, সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়া, বন্দরে জট, সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতিসহ সবকিছু বিবেচনায় রেখে তারা এ অনুরোধ জানাতে বাধ্য হয়েছেন।

এ পরিস্থিতিতে কী করতে হবে? এমন প্রশ্নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সুষ্ঠু বণ্টন করতে হবে। দরিদ্র, অতিদরিদ্র ও করোনার কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা যেন প্রণোদনার সুফল পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা যেন সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিনই প্রায় আড়াইশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। গতকালও সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৩৯। করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাও আছে কয়েক শ। গতকাল দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ২৭১ জন। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ২৬ হাজার ২৫৩ জন। আর মৃত্যু ছাড়িয়ে গেছে ২০ হাজারের ঘর (২০,২৫৫ জন)। এর সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অবশ্য শুধু রাজধানীতে। মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার আরও ১৯৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ বছর একদিনে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২৯ জুলাই সকাল পর্যন্ত ২ হাজার ২৯২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। এই বছরের সর্বাধিক ১ হাজার ৯২০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে শুধু জুলাই মাসেই, যা এ বছর মোট আক্রান্তের শতকরা ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

করোনার ব্যাপক বিস্তার রোধে বিধিনিষেধের আদলে বারবার লকডাউনের কারণে অর্থনীতির গতি কমেছে, বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ। স্বভাবতই মানুষের ক্রয় ক্ষমতায় বড় টান পড়েছে, নিত্যদিনের চাহিদা মেটানো দায় হয়ে পড়েছে তাদের। আয় কমে যাওয়ায় মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনের তুলনায় ব্যয় কমিয়েছেন। তার নিচের স্তরের মানুষ প্রয়োজন বিবেচনায় গুরুত্ব দিচ্ছে অগ্রাধিকার খাতকে। এরও নিচের স্তরের লোকজন অল্প খেয়ে পড়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত। ভোক্তার অতিরিক্ত ভোগ প্রবণতা কমে গেছে। করোনায় দেড় বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয় খাতে। বিনিয়োগ কমায় কর্মসংস্থান কমেছে। এর প্রভাবে কমেছে আয়ও।

চলতি বছরে দুই ঈদ, যা ব্যবসার মৌসুম হিসেবে বিবেচিত, সেই সময়ও ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি করোনার কারণে। ঈদুল ফিতরে বিকিকিনি প্রত্যাশিত মাত্রার হয়নি। করোনার ছোবলে অর্থনীতি যে বিপর্যস্ত, তা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে ঈদুল আজহায় বা কোরবানির ঈদে। এবার ২৮ লাখ ২৩ হাজার পশু কম বিক্রি হয়েছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খামারি ও ব্যাপারীরা। করোনার প্রকোপে একের পর এক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণির সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্র মতে, করোনার প্রভাবে স্বল্প বেতনের অদক্ষ কর্মীদের আয় বেশি কমেছে। যারা অস্থায়ী কর্মী, তাদের আয়ও বেশি কমেছে। একই সঙ্গে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতেও শ্রমিকদের আয় কমেছে। অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে স্বল্প বেতনের দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের চলাচল কমে যাওয়ায় তাদের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত রয়েছে। আয় কমায় আর্থসামাজিকভাবে তাদের একটি দুর্বল অবস্থানে ফেলেছে।

করোনায় বেসরকারি খাতে ৪০ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। অবশ্য, সরকারি হিসাব বলছে, এ সংখ্যা ১৬ লাখের বেশি। আয়শূন্য এসব মানুষের বেশিরভাগ আজও নতুন করে কোনো কাজ জোটাতে পারেনি। অনেকের কমে গেছে আগের নিয়মিত আয়ও। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, গত সোয়া এক বছরে নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে দেশের আড়াই থেকে ৩ কোটি মানুষ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ নেমেছে। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, কাজ হারানো, কাজের অনিশ্চয়তার কারণে কোরবানির সময় মানুষ যেভাবে খরচের যে পরিকল্পনা থাকে, সেটা এবার সম্ভব হয়নি। সে কারণেই দেখছি যে কোরবানির পশুর বড় একটা অংশ অবিক্রীত থেকে গেছে।’

অন্যদিকে সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ দরিদ্র পরিবারে খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমেছে। সঞ্চয় কমেছে ৬৫ শতাংশ দরিদ্রের। সিডিপির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলছেন, প্রান্তিক মানুষদের জন্য সাহায্যের প্যাকেজ চালুর ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেই জায়গায় এখনো খুব ধীরগতিতে এগুচ্ছি আমরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আমাদের সময়কে বলেন, প্রথমে আমাদের বের করতে হবে কত লোক দারিদ্র্য হয়েছে। তালিকা করে তাদের কাছে অর্থ পৌঁছাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে, যাতে এ ক্ষেত্রে সঠিক লোক সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ